নাটকে নাটক
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
অমিতের তখন অভিনেতা হিসাবে ভালোই নাম ডাক হয়েছে। আশেপাশের নাট্য দল থেকে মাঝেমধ্যেই তার ডাক পড়ছে বড়ো বড়ো চরিত্রে অভিনয় করার জন্য। তারমধ্যে ডি.এল রায়ের শাজাহান নাটকে ঔরঙ্গজেবের চরিত্রে অভিনয় করে তার পরিচিতি আরও বেড়ে গেল। হঠাৎ একদিন পাড়ার ছোটদের নাটকের দলের কয়েকটি ছেলে এসে অমিতকে ধরলো তাদের নাটকে একটা চরিত্র করে দেওয়ার জন্য। ছোট মানে, অমিতের বয়স তখন তেইশ আর তারা সব চোদ্দো পনেরো। তো সেই দলের ছেলেরা মানে অজয়, পুটু, দিপাল নাটক করার আমন্ত্রণ পেয়েছে আমাদের গ্রাম থেকে কিছু দূরে একটা কোম্পানির রিক্রিয়েশন ক্লাবে। তাদের নাটকে দু’টো বয়ষ্ক চরিত্রে অভিনয় করে দেওয়ার জন্য তারা অমিত আর গোপালকে ধরেছে। অমিতের তখন বেশ নাম ডাক, আর ওই বয়সে ভালো অভিনেতা হিসাবে নাম করে ফেলাতে অমিত মনে মনে একটু গর্বও অনুভব করে। অজয়, দিপালরা রিহার্সালে যাওয়ার জন্য তাড়া লাগায় আর অমিত তাদের তুড়ি মেরে বলে, ‘যা যাঃ, তোরা নিজেরা রিহার্সাল করগে যা, আর গোপালটাকে ভালো করে রিহার্সাল করা। আমাকে দেখতে হবেনা, আমি ঠিক করে দেবো’। ছোটরা কিছু বলতে সাহস করে না। একে অমিত তখন নামকরা অভিনেতা, তার উপর ডাকাবুকো ছেলে বলে পাড়ার ছোটরা তাকে একটু ভয়ই পায়। তারা নিজেরাই রিহার্সাল করে আর গোপাল নিজের তাগিদেই রিহার্সাল করে। কেন না গোপাল নিজে তো বটেই এমনকি পাড়ার লোকেরাও জানে যে মঞ্চে ওঠার ব্যাপারে সে খুব নার্ভাস। নাটক করার ইচ্ছা খুব, কিন্তু প্রতিবারই ঠিক মঞ্চে ওঠার সময়েই তার নার্ভ ফেল করে। নাটকের দিন এগিয়ে আসতে লাগলো। অমিত দু-এক দিন রিহার্সাল করলো। পার্ট ঠিক মতো মুখস্থ হয়নি। ছেলেরা বলাতে অমিত বললো, ‘ও নিয়ে ভাবিস না, সব মুখস্থ হয়ে যাবে’। রিহার্সাল হতো পুটূদের বাড়ির বৈঠকখানায়। নাটকের একটা দৃশ্য ছিল যেখানে শিল্পপতি অনিমেষ সেনের (অমিত) ড্রইংরুমে ডাক্তার (পিন্টু) এসে অনিমেষ সেনকে পরীক্ষা করে একটা ইঞ্জেকশন দিচ্ছে, আর অনিমেষ সেন তার ছেলেকে (পুটু) তার খারাপ কাজের জন্য ইংরাজিতে খুব বকাবকি করছে, আর সেই ঘরেই এককোনে বসে তখন মদ্যপান করছে অনিমেষের বন্ধু প্রকাশ (অনন্ত)। রিহার্সাল দেওয়ার সময় অনন্ত রোজই পুটুদের একটা জল খাওয়ার গ্লাস নিয়ে রিহার্সাল করতো, আর জল খাওয়ার মতো করে আলগোছে মদ খেতো। সবাই বকাবকি করলে বলতো, ‘আরে স্টেজে কি আর আলগোছে মদ খাবো নাকি’। দেখতে দেখতে নাটকের দিনও এসে গেল। দলের ছেলেরা সবকিছু গোছগাছ করে নিয়ে, গিয়ে পৌঁছলো নাটকের জায়গায়। মঞ্চ টঞ্চ সাজিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি সবাই মেকাপ সেরে নিলো। আর ঠিক মেকাপ নেওয়ার পরেই অমিত বুঝতে পারলো আজকের পার্টটা যেন তার ঠিক মতো আয়ত্তে নেই। বিশেষ করে ছেলেকে বকাবকি করার দৃশ্যে অতগুলো ইংরাজি শব্দ ঠিক মতো মনে পরছে না যেন মাথার মধ্যে সব গুলিয়ে যাচ্ছে। সে গুম হয়ে একটা চেয়ারে বসে পার্টটা দেখতে লাগলো। ওদিকে গোপালকে দেখা গেল নিজের পার্ট হাতে মঞ্চের পিছনে খুব ব্যস্তভাবে পায়চারি করছে। সময় মতো নাটক শুরুও হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নাটক জমে গেল। একটার পর একটা দৃশ্য চলছে, সবাই মোটামুটি ভালোই অভিনয় করছে। অমিতেরও দু’টো দৃশ্যে অভিনয় হয়ে গেছে, ভালোই উতরে গেছে, অমিত অনেকটা নিশ্চিত। আর দু’টো দৃশ্য আছে, হয়ে যাবে, মনে মনে ভাবলো অমিত। আরও দু’টো দৃশ্যের পর এলো অমিতের সেই দৃশ্যটা। যেখানে অমিত মানে অনিমেষ, তার ছেলেকে বকাবকি করছে, ডাক্তার অনিমেষকে ইঞ্জেকশন দিচ্ছে, আর প্রকাশ বসে বসে মদ্যপান করছে। দৃশ্যের শুরুটা ভালোই হলো, কিন্তু গন্ডোগোলটা হলো ছেলেকে বকাবকি করার সময়। ডায়ালগ বলতে গিয়ে অমিত বুঝলো তার মাথা পুরো ফাঁকা। অমিতের ডায়ালগ ছিল, ‘why are you going to the below standard’. কিন্তু অমিতের why টা ছাড়া আর কিছুই মনে পরছে না। মঞ্চের উপর অমিত ঘামতে শুরু করলো। সে বার দুয়েক why why বলেছে, হঠাৎ দেখলো অনন্ত সেই গ্লাস থেকে আলগোছে মদ খাচ্ছে, আর সেটা দেখে দর্শক একটু আওয়াজ করে উঠলো, আর তাতে ঘাবড়ে গিয়ে অমিতের মুখ দিয়ে ‘why are you going to the below standard’ এর বদলে বেড়িয়ে এলো শুধু তিনটি শব্দ, ‘why to do’. বলেই অমিত চুপ, আর অমিতের ওই ডায়ালগ শুনে আরও ঘাবড়ে গেল ডাক্তার বেশি পিন্টু। সে এতোই ঘাবড়ে গেল যে ইঞ্জেকশন দেওয়ার সময় অনিমেষের ফুল হাতা জামার হাতা না গুটিয়ে জামার উপর দিয়েই ইঞ্জেকশন দিয়ে দিলো, আর তাতে আরও হাসির রোল উঠলো দর্শকদের মধ্যে। অমিত যা হোক করে সিনটা ম্যানেজ করলো বটে, কিন্তু তার ধাক্কাটা গিয়ে পৌঁছলো মঞ্চের পিছনে। মঞ্চের উপর ওইসব তালগোল দেখে গোপালের নার্ভাস সিস্টেম একেবারেই ফিউজ হয়ে গেল। সে ছুটে গিয়ে অজয়ের হাত চেপে ধরলো, ‘ভাই আমাকে বাদ দে’। অজয় তো আকাশ থেকে পড়লো, ‘বাদ দেব মানে’! গোপাল বললো, ‘আমার কিছুই মনে পরছে না, সব ভুলে গেছি’। অজয় অবাক, ‘ভুলে গেছো কি গো’? গোপাল বললো, ‘হ্যাঁ ভাই সব ভুলে গেছি, দেখ মঞ্চে উঠে দাঁড়িয়ে থাকার থেকে তো না ওঠা ভালো, তুই আমার দৃশ্যটা বাদ দিয়ে দে ভাই।’ অজয়ের ভীষণ বিরক্ত লাগলো। নাটকটা বেশ ভালোই চলছিলো হঠাৎ একটা দৃশ্য গুবলেট হয়ে গেল, তার উপর গোপালদার এই অবান্তর কথা। সে একরকম বিরক্ত হয়েই বললো, ‘ঠিক আছে যাও তোমাকে মঞ্চে উঠতে হবে না, তোমার সিনটা বাদ দিয়ে দেব’। গোপাল তো হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো, কিন্তু বিপদে পরলো আর একজন, মিত্তিরদের বিশু। সে ওই নাটকে এক প্রতিবাদী যুবকের চরিত্রে অভিনয় করছে। দৃশ্যটা ছিল, মাস্টার মশাই, মানে গোপাল মঞ্চে বক্তৃতা দেবে আর বিশু দর্শক আসন থেকে দাঁড়িয়ে বলবে, ‘থামুন মাস্টার মশাই, আগে আমার কথার জবাব দিন’। তারপর দর্শকদের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গিয়ে মঞ্চে উঠবে। সেইজন্য বিশু নাটক শুরুর আগে থেকেই মেকাপ নিয়ে দর্শকদের মধ্যে গিয়ে বসে আছে। তার আশেপাশের দু’একজন, অচেনা মুখ দেখে জিজ্ঞাসা করেছে, ‘ভাই তুমি’? বিশু বেশ গর্বের সঙ্গে উত্তর দিয়েছে, ‘আমার রোল আছে নাটকে’। নাটক এগিয়ে যাচ্ছে। পাশের লোকজন আবার জিজ্ঞাসা করলো, ‘কি ভাই কখন তোমার রোল’? বিশু বললো, ‘আসবে আসবে’। আর আসবে, মাস্টার মশাই তো ভেগেছে, আর মাস্টার মশাই না উঠলে প্রতিবাদী যুবক মঞ্চে উঠবে কি করে? এদিকে নাটক যত গড়ায় পাশের লোক তত খোঁচায়, আর প্রতিবাদী যুবক তত উত্তেজিত হয়ে ওঠে, সে বুঝে উঠতে পারে না যে তার দৃশ্যটা আসছে না কেন। এই করতে করতে নাটক শেষ হয়ে গেল, কিন্তু প্রতিবাদী যুবকের মঞ্চে আর ওঠা হলো না। যাওয়ার সময় পাশের লোকগুলো বলে গেল, ‘হুঁঃ, খালি চ্যংড়ামো, এসেছে নাটক দেখতে, আর সমানে বলে যাচ্ছে, নাটকে রোল আছে, যত্তোসব’। সেই খোঁচা খেয়ে বিশু লাফাতে লাফাতে চললো গ্রীনরুমে। গ্রীনরুমে গিয়েই রুদ্রমূর্তি। প্রথমেই ধরলো গোপালকে, ‘তুমি মঞ্চে উঠলে না কেন’? গোপাল ভয় পেয়ে বললো, ‘আমাকে অজয় উঠতে বারণ করেছে’। এবার বিশু খুঁজতে লাগলো অজয়কে, আর অজয় গিয়ে লুকালো অমিতের পিছনে। বিশুর রাগ তখন তুঙ্গে। যে কিছু বলছে তাকেই মারতে যাচ্ছে। অবশেষে অমিত বুঝিয়ে বলাতে সে একটু চুপ করলো, কেননা অমিতের সঙ্গে তর্ক করার সাহস তার নেই। কি আর করে, গ্রীনরুমের এককোনে বসে গজগজ করতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবকিছু গোছগাছ করে নিয়ে ওরা বেড়িয়ে পরলো। অমিতের মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল সিনটা বিগড়ে যাওয়ার জন্য। সে একটা জিনিষ বুঝতে পারলো যে ফাঁকি দিয়ে কোন কাজ ভালোভাবে করা যায় না আর এই ভাবনাই পরবর্তী কালে অভিনেতা অমিতকে অনেক দূর নিয়ে গিয়েছিল। অবশ্য সেদিন আর একটা ব্যাপারও অমিতের খুব খারাপ লেগেছিল। নাটকের শেষে দু’টো লোক এসে বলে গেল, ‘ভাই পরের বার থেকে মদটা গ্লাসে চুমুক দিয়ে খেয়ো আর ইঞ্জেকশনটা দেওয়ার সময় জামার হাতাটা গুটিয়ে নিয়ো।।
খুব ভাল লাগলো